মুক্তবাজার, অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং উন্মুক্ততা, লাগামহীন বেসরকারিকরণ, বি-নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্যপুঁজির অবাধ প্রবাহ, এগুলোই আজকের বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার সমার্থক। এর পেছনে রয়েছে বহুজাতিক পুঁজি এবং বাজার সম্প্রসারণ কেন্দ্রিক চিড়াভাবনা। বহুজাতিক পুঁজি ও রাষ্ট্রের মধ্যকার জটিল ও গতিশীল সম্পর্কের মধ্যদিয়েই বিশ্বায়নের আকার, পরিধি ও প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। এটা সত্য, বর্তমান পর্যায়ের বিশ্বায়ন রাষ্ট্রের কার্যকর অংশগ্রহণ ছাড়া কখনোই সম্ভব হতো না। বাণিজ্যের উদারীকরণ, বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি ও শিল্প সংক্রান্ড নীতিমালা প্রবর্তনের মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র কার্যকরভাবে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছে। যাহোক বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া সংঘটনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কার্যকর সম্পৃক্ততা সত্ত্বেও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, আদতেই বহুজাতিক পুঁজির সঙ্গে রাষ্ট্রের একটি দ্বন্ধ বিরাজ করছে।
যেহেতু রাষ্ট্র ও পুঁজি এ দুটি সত্তার যৌক্তিক অবস্থান ভিন্ন, তাই এ দুয়ের দ্বন্দ্ব নিরসন হওয়ার নয়। বহুজাতিক পুঁজির একমাত্র লক্ষ্য হলো মুনাফা অর্জন আর রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হলো নানা ধরনের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে নাগরিকদের চাহিদা পূরণ করা।
কিন্তু বহুজাতিক পুঁজি এবং তাদের প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত বিশ্বসংস্থাসমূহের (IMF, WB, WTO) বিশ্ব শাসন ব্যবস্থা সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। রাষ্ট্র চাইলেই এ সকল বিশ্বসংস্থা এবং এদের বাণিজ্যনীতিকে উপেক্ষা করতে পারছে না। অনেক ক্ষেত্রে এ বিশ্বায়নকে মেনে নিতে গরিব রাষ্ট্রগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কলাকৌশল প্রয়োগ করার মধ্যদিয়ে উন্নয়নশীল ও উত্তরণশীল ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিল সেসব দেশকে কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির অধীনে নানা ধরনের কঠিন শর্তের জালে আটকে তাদের নিজ নিজ বাজার উন্মুক্ত করতে বাধ্য করা হয়েছে এবং এর মধ্যদিয়ে বহুজাতিক এবং অভ্যন্ড্ররীণ পুঁজিপতিদের স্বার্থের ও পুঁজির উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বিশ্বায়ন এভাবে আন্তর্জাতিক পুঁজি ব্যবস্থাপক ও তাদের স্থানীয় দোসরদের সামনে ফটকাবাজির অবারিত সুযোগ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে এটি দরিদ্রমুখী ও পুন:বণ্টনমূলক জননীতির ক্ষেত্রে মারাত্মক বাধার সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্রসমূহ তার কল্যাণমূক ব্যয় সঙ্কুচিত করছে।
অবস্থাদৃষ্টে এ ভাবনার উদ্রেক করা অসমীচীন নয়, রাষ্ট্রসমূহ পুঁজিপতিদের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে। বেসরকারিকরণ কারখানা বন্ধ করে দেওয়া, দেশীয় শিল্পের মৃত্যু, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সাবকন্ট্রাকটিং এসবের ফলে শ্রমজীবী মানুষের দর কষাকষির ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অর্থনীতিকে আমদানি নির্ভর করা হচ্ছে। জাতীয় সম্পদ (গ্যাস, তেল, কয়লা ও স্বর্ণ) রক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র জনগণের আশা আঙ্ক্ষার প্রতিফলক না হয়ে বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করছে।