ইলম নিছক ইলম নয়; ইলম বরং দ্বীন। এই বক্তব্য আমার নয়। জগদ্বিখ্যাত তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনে সিরিনের। বিখ্যাত তাবিয়ী ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন রহ. (১১০ হি.) বলেন, “নিশ্চয় এই ইলম হলো দ্বীন। সুতরাং তোমরা কার কাছ থেকে দ্বীন গ্রহণ করবে, ভালোমতো অনুসন্ধান করে নাও”।[সহিহ মুসলিম ১/১১, ইমাম মুসলিমের ভূমিকা; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, আসার নং-২৬৬৩৬]
ইলমে দ্বীন অর্জনের পদ্ধতি ও শর্তাবলি আলোচনার ক্ষেত্রে সালাফদের যে-ক’টি বক্তব্য ফান্ডামেন্টাল হওয়ার দাবি রাখে, ইবনে সিরিনের এই বক্তব্য তার অন্যতম। বলাবাহুল্য, কুরআন, হাদিস এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট তাফসির ও উলুমুল কুরআন, শারহুল হাদিস ও উলুমুল হাদিস, ফিকহ ও উলুমুল ফিকহ—এই সবকিছুই ইলম। এবং এই ইলমের সামষ্টিক রূপই শরিয়াহ বা দ্বীন।
অর্থাৎ, ইসলামি শরিয়াহ দাঁড়িয়েই আছে ইলমের ভিত্তির ওপর। এর কোনোটি ভেঙে পড়ার মানে হলো—শরিয়ার একটি ভিত ভেঙে পড়া।
কেননা, নবীজি, সাহাবা ও সালাফদের ব্যাখ্যা, বক্তব্য ও আমলের আলোকে কুরআন ও হাদিসের সামষ্টিক রূপই শরিয়ার রূপ। একারণে, উলুমে শরিয়ার প্রতিটি শাস্ত্রের যেমন উসুল ও মূলনীতি আছে, তেমনি সামগ্রিকভাবে উলুমে শরিয়া অর্জনেরও আছে নির্দিষ্ট উসুল ও মূলনীতি। আর এর সর্বপ্রথম ধাপ হচ্ছে—উস্তাদ নির্বাচন করা।
ইবনে সিরিন কেন এই কথা বললেন, কোত্থেকে এই ফিকরা পেলেন, কাদের অধীনে তাঁর ইলমি তারবিয়ত হয়েছে, কোন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন? ইবনে সিরিনের বক্তব্য বুঝতে হলে এই প্রশ্নগুলোর পাশাপাশি তাঁর সময় ও অবস্থান বুঝতে হবে।
ইবনে সিরিন রহ. জন্মগ্রহণ করেন ৩২ হিজরিতে। মুসলিম বিশ্বে তখন খেলাফতে রাশেদা চলছে। খেলাফতের দায়িত্ব পালন করছেন দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু। যার সময়ে শরিয়া ও উলুমে শরিয়া নিয়ে কোনো অপব্যাখ্যা করার সাহস কারও ছিল না। ইবনে সিরিন যখন জন্মগ্রহণ করেন, আশারায়ে মুবাশশারার একাধিক সাহাবি সহ অধিকাংশ বড় সাহাবিই তখন জীবিত। প্রত্যেকেই নিজ-নিজ পরিসরে দ্বীন ও ইলমে দ্বীন প্রচার-প্রসারের কাজ করে যাচ্ছেন।
মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন রহ.-এর ইলম অর্জনের হাতেখড়ি থেকে নিয়ে উন্নতির শিখরে আরোহণ, সিংহভাগটাই হয়েছে সাহাবিদের হাত ধরে। তাঁর ইলম অর্জন শুরু হতে-হতে কিছু বড় সাহাবির ইন্তেকাল হয়ে গেলেও অনেক বড় সাহাবি তখনো জীবিত ছিলেন। শেষদিকের তো অনেকেই জীবিত ছিলেন।
ইবনে সিরিনের ইলমি ব্যুৎপত্তি যাদের হাত ধরে হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হযরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু, ইমরান ইবনে হুছাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহু এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ দশ বছরের একান্ত খাদেম আনাস ইবনে মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহু। এই পাঁচজনের মধ্যে চারজনই প্রথম সারির আলিম সাহাবি।[সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৪/৬০৬]
অন্যান্য তাবিয়ীর থেকে ইলম অর্জন করলেও ইবনে সিরিন রহ.-এর ইলমি ভিত, শরিয়া সম্পর্কে মনোভাব ও চিন্তাজগত—এগুলো গড়ে উঠেছিল মূলত উপরোক্ত চারজন বিজ্ঞ সাহাবির তত্ত্বাবধানে। ফলতঃ, ইবনে সিরিনের এই বক্তব্য নিছক তাঁর ব্যক্তিগত উপলব্ধি নয়; বরং উপরোক্ত চারজন প্রথম সারির আলিম সাহাবির ইনফ্লুয়েন্স ও সমকালীন পরিবেশের ইলমি চিন্তাজগতের প্রতিচ্ছবি।
এই চিন্তা ও মনোভাব যে কেবল মুহাম্মাদ ইবনে সিরিনের ছিল, তা নয়। বরং সালাফদের প্রায় সকলেই এই ফিকরা লালন করতেন। কারণ, তাঁরা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে চলে আসা ইলমি সিলসিলায় এর অন্যথা পাননি। আরেকটি বক্তব্য উল্লেখ করে এর প্রমাণ দিই।
ইবনে সিরিনের সমসাময়িক আরেক বিখ্যাত ইমাম হলেন তাবিয়ী ইবরাহিম নাখয়ী রহ. (৯৬ হি.)। হানাফি মাযহাবের ফিকহি সিলসিলায় ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহুর পর যিনি প্রধান পুরুষ। বয়সে ইবনে সিরিনের চেয়ে পনেরো বছর ছোট হলেও ইন্তেকাল করেছেন তাঁর পনেরো বছর আগে। ৪৭ হিজরি থেকে ৯৬ হিজরি—প্রায় পঞ্চাশ বছরের জীবনে এটি ছিল তাঁর সমকাল।
তবে ইবনে সিরিনের সাথে তাঁর পার্থক্য হলো—ইবরাহিম নাখয়ীর ইলমি ব্যুৎপত্তি ঘটেছে প্রধান-প্রধান তাবিয়ীদের হাত ধরে। একাধিক সাহাবির সাক্ষাৎ-সান্নিধ্য পেলেও ইলমি সোহবত পাননি। দুজনের উস্তাদগত পার্থক্য হয়ে গেলেও সমকালীন পরিবেশের প্রভাবে চিন্তাগত জায়গায় উভয়েই ছিলেন এক।
মুহাম্মাদ ইবনে সিরিন উসুলী আঙ্গিকে কথা বললেও ইবরাহিম নাখয়ী তুলে ধরেছেন সমকালীন পরিস্থিতির একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র। তিনি বলেন, “ইলম অন্বেষণকারীরা যখন কোনো উস্তাদের কাছে ইলম অর্জনের জন্য যেতেন, তখন তাঁরা উস্তাদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে অনুসন্ধান করতেন। তাঁর নামাজ ও সামগ্রিক অবস্থার খোঁজখবর করতেন। তারপর ইলম অর্জন করতেন।”[আল-জামি লি-আখলাকির রাবি ওয়াস সামি ১/১২৮]
অর্থাৎ, আগে উস্তাদের অবস্থা যাচাই করতেন, তারপর ইলম গ্রহণ করতেন। কারণ, ইলমের সমষ্টিগত রূপই দ্বীন। আর, দ্বীন যার-তার কাছ থেকে গ্রহণের বিষয় নয়। এর জন্য প্রয়োজন উস্তাদের যথাযথ যোগ্যতা ও শর্তাবলির সন্নিবেশ।